হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত

আজকাল যাহাকে সাধারণভাবে ‘বেদান্ত-দর্শন’ বলা হয়। ভারতের বর্তমান বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়গুলির সব সত্যই তাহার অন্তর্গত। সে জন্য নানাভাবে ইহার ব... thumbnail 1 summary
আজকাল যাহাকে সাধারণভাবে ‘বেদান্ত-দর্শন’ বলা হয়। ভারতের বর্তমান বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়গুলির সব সত্যই তাহার অন্তর্গত। সে জন্য নানাভাবে ইহার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে, এবং আমার মনে হয়, ক্রমোন্নতির ধারায় তাহা হইয়াছে—দ্বৈতবাদে সেগুলির আরম্ভ এবং অদ্বৈতবাদে পরিসমাপ্তি। বেদান্তের শব্দগত অর্থ বেদের অন্ত বা শেষ;—বেদ হিন্দুদের শাস্ত্র।১ পাশ্চাত্যে কখন কখন ‘বেদ’ বলিতে উহার স্তোত্র ও আনুষ্ঠানিক অংশ-মাত্র বোঝায়। কিন্তু বর্তমানকালে বেদের এই অংশের ব্যবহার প্রায় নাই বলিলেই চলে; ভারতে এখন ‘বেদ’ বলিতে সাধারণতঃ বেদান্তই বোঝায়। সব ভাষ্যকারই শাস্ত্রোক্তি উদ্ধৃত করিবার সময় বেদান্ত হইতেই লইয়া থাকেন—ইহাই নিয়ম; ভাষ্যকার-গণের কাছে বেদান্তের আর একটি বিশেষ নাম ‘শ্রুতি’২। ‘বেদান্ত’ নামে পরিচিত সব গ্রন্থই বেদের ক্রিয়াকাণ্ডের পরে রচিত হয় নাই। যেমন ‘ঈশোপনিষদ্’ নামক বেদান্ত-গ্রন্থ যজুর্বেদের বিংশ অধ্যায়ে রহিয়াছে, ইহা বেদের প্রাচীনতম খণ্ড। বেদের ব্রাহ্মণ বা অনুষ্ঠানমূলক অংশেও অপর কয়েকখানি উপনিষদ্৩ রহিয়াছে। বাকী উপনিষদ্‌গুলি স্বতন্ত্র, বেদের ব্রাহ্মণ বা অন্য কোন অংশের অন্তর্ভূক্ত নয়। কিন্তু সেগুলি যে বেদের অন্য অংশ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এ-কথা ভাবিবার কোন হেতু নাই, কারণ আমরা জানি এগুলির মধ্যে অনেকগুলিই একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, এবং বহু ব্রাহ্মণ-অংশও লুপ্ত হইয়াছে। কাজেই ইহা খুবই সম্ভব যে, এই উপনিষদ্‌গুলি কোন-না-কোন ‘ব্রাহ্মণ’-এর অন্তর্ভূক্ত ছিল, কালক্রমে সেই ব্রাহ্মণ-অংশগুলি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু উপনিষদ্‌গুলি রহিয়া গিয়াছে। এই উপনিষদ্‌গুলি ‘আরণ্যক’ নামেও অভিহিত।

কাজেই বেদান্তই কার্যতঃ হিন্দুদের শাস্ত্রগ্রন্থ, এবং ভারতীয় দর্শনে যতগুলি আস্তিক মতবাদ আছে, তাহাদের সবগুলিই বেদান্তকে ভিত্তিরূপে গ্রহণ করিয়াছে। এমন কি উদ্দেশ্য-সিদ্ধির উপযোগী হইলে বৌদ্ধ এবং জৈনেরা পর্যন্ত প্রমাণরূপে বেদান্তের শ্লোক উদ্ধৃত করেন। ভারতের সব দার্শনিক মতবাদই বেদকে ভিত্তি বলিয়া দাবি করিলেও প্রত্যেক মতই ভিন্ন গ্রহণ করিয়াছে। সর্বশেষটি ব্যাসের মত; ইহা পরিবর্তী অন্যান্য দার্শনিক মতগুলি অপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণে বেদনিষ্ঠ; এবং ইহা সাংখ্য, ন্যায় প্রভৃতি পূর্ববর্তী দর্শন-গুলির সঙ্গে বেদান্তের উক্তির সামঞ্জস্য-বিধানের চেষ্টা করিয়াছে। সেইজন্য বিশেষভাবে ইহাকেই ‘বেদান্ত-দর্শন’ বলা হয়; বর্তমান ভারতে ‘ব্যাসসূত্র’ গুলিই বেদান্ত-দর্শনের ভিত্তি। বিভিন্ন ভাষ্যকারগণ আবার এই ব্যাসসূত্রগুলির বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। সাধারণতঃ ভারতে এখন তিন শ্রেণীর ভাষ্যকার৪ রহিয়াছেন। তাঁহাদের ব্যাখ্যা অবলম্বনে তিনটি দার্শনিক মত ও সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিয়াছে—প্রথমটি দ্বৈত, দ্বিতীয়টি বিশিষ্টাদ্বৈত এবং তৃতীয়টি অদ্বৈত। ইঁহাদের মধ্যে দ্বৈতবাদী ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর সংখ্যাই ভারতে সর্বাপেক্ষা বেশী; তাঁহাদের তুলনায় অদ্বৈতবাদীর সংখ্যা অতি অল্প। এই তিনটি মতবাদেরই ভাবধারা আপনাদের নিকট উপস্থাপিত করিবার চেষ্টা করিব; তবে আরম্ভ করিবার পূর্বে একটি কথা বলিয়া রাখি—সাংখ্যদর্শনের মনোবিজ্ঞানই এই তিনটি মতবাদের সাধারন মনোবিজ্ঞান। সাংখ্য মনোবিজ্ঞান সঙ্গে ন্যায় ও বৈশেষিক মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট সামঞ্জস্য রহিয়াছে, বিরোধ শুধু কয়েকটি অপ্রধান খুঁটিনাটি বিষয় লইয়া।

তিনটি বিষয়ে সব বেদান্তবাদীই একমত; সকলেই ঈশ্বরে, বেদে এবং কল্পে বিশ্বাসী। বেদের কথা পূর্বেই আলোচিত হইয়াছে। ‘কল্প’ সম্বন্ধে বিশ্বাস এইরূপ : বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা-কিছু জড়পদার্থ আছে, সে-সকলই ‘আকাশ’ নামক একটি মূল পদার্থ হইতে সৃষ্ট; এবং সব শক্তিই—মাধ্যাকর্ষণ, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ, জীবনীশক্তি বা যে-কোন শক্তি হউক না কেন, সবই—’প্রাণ’ নামক একটি মূল শক্তি হইতে উদ্ভুত। আকাশের উপর প্রাণের ক্রিয়ার ফলেই এই বিশ্ব সৃষ্ট বা অধ্যস্ত৫ হইয়াছে। কল্পারম্ভে আকাশ গতিহীন, অনভিব্যক্ত থাকে। তারপর উহার উপর প্রাণের ক্রিয়া শুরু হয়, আর প্রাণ যতই ক্রিয়াশীল হয়, আকাশ হইতে ততই গ্রহ প্রাণী মানুষ নক্ষত্র প্রভৃতি স্থূল ও স্থূলতর পদার্থের সৃষ্টি হইতে থাকে। গণনাতীত কালের পর এই অভিব্যক্তি থামিয়া যায়, এবং বিলয় শুরু হয়; প্রত্যেক বস্তুই সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর বস্তুতে বিলীন হইতে হইতে পুনরায় মূল আকাশ ও প্রাণে পরিণত হয়। তখন নূতন ‘কল্প’ আরম্ভ হয়। প্রাণ এবং আকাশের পারেও কিছু আছে, উভয়কে বিরাট মন বা ‘মহৎ’ নামক তৃতীয় সত্তায় বিলীন করা যাইতে পারে। বিরাট মন—আকাশ বা প্রাণ সৃষ্টি করে না, নিজেকেই প্রাণ ও আকাশে রূপায়িত করে।

এখন মন, আত্মা ও ঈশ্বর-বিষয়ে বিশ্বাস লইয়া আমরা আলোচনা করিব। সর্বজনগ্রাহ্য সাংখ্য মনস্তত্ত্ব অনুসারে অনুভূতির ক্ষেত্রে—যেমন কোন-কিছু দেখার সময়—প্রথমেই দেখিবার যন্ত্র বা করণ চক্ষু। চক্ষুর পিছনে দর্শনের ইন্দ্রিয়—চক্ষুর স্নায়ু ও স্নায়ুকেন্দ্র রহিয়াছে; এগুলি বাহিরের যন্ত্র নয়, কিন্তু এগুলি ছাড়া চক্ষু দেখিতে পারিবে না। অনুভূতিুর জন্য আরও কিছুর প্রয়োজন। মন থাকা চাই এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগও চাই। এ ছাড়াও বেদনাকে বুদ্ধির বা মনের প্রতিক্রিয়াশীল নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তির কাছে পৌঁছাইয়া দেওয়া চাই; বুদ্ধির নিকট হইতে প্রতিক্রিয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে বহির্জগৎ প্রতিভাত হয় এবং অহং-বোধও জাগ্রত হয়। তারপর আসে ইচ্ছা; কিন্তু তবু সব হইল না। যেমন পরপর বিচ্ছুরিত আলোর স্পন্দনে প্রস্ফুট কয়েকটি চিত্রকে লইয়া একটি সম্পূর্ণ চিত্র ফুটাইয়া তুলিতে হইলে সেগুলির প্রত্যেকটিকে কোন একটি স্থির বস্তুর উপর ফেলিতে হয় , সেইরূপ মনের প্রত্যেকটি ভাবকেও একত্র করিয়া দেহ ও মনের তুলনায় যাহা স্থির, সেরূপ কোন একটি পদার্থের উপর প্রক্ষেপ করিতেই হইবে; এই স্থির পদার্থটি জীবাত্মা—পুরুষ বা আত্মা।

সাংখ্যদর্শনের মতে ‘বুদ্ধি’ নামক মনের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থাটি মহৎ বা বিরাট মনের পরিণাম, রূপান্তর বা একটি বিশেষ অভিব্যক্তি। মহৎ-ই স্পন্দনশীল চিন্তায় রূপান্তরিত হয়; এবং উহা এক অংশে পরিবর্তিত হইয়া ইন্দ্রিয় হয়, অপর অংশে হয় সূক্ষ্ম ভূত (তন্মাত্র)। এই-সব কিছুর সমবায়ে সমগ্র বিশ্ব সৃষ্ট হয়। সাংখ্যদর্শনের মতে এই মহৎ-এরও পরে আর একটি অবস্থা আছে, যাহার নাম ‘অব্যক্ত’ বা অপ্রকাশিত; সেখানে মনেরও প্রকাশ নাই, শুধু কারণগুলি থাকে। এই অবস্থার আর একটি নাম ‘প্রকৃতি’। এই প্রকৃতির পারে প্রকৃতি হইতে চির-স্বতন্ত্র পুরুষ রহিয়াছেন; ইনিই সাংখ্যের নির্গুণ সর্বব্যাপী আত্মা। পুরুষ কর্তা নন, সাক্ষী-মাত্র। পুরুষকে বুঝাইতে স্ফটিকের উদাহরণ দেওয়া হয়। পুরুষ বর্ণহীন স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো; উহার সম্মুখে বিভিন্ন বর্ণ রাখিলে উহাকে সেই-সব বর্ণে রঞ্জিত বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ফটিক তাহাতে রঞ্জিত হয় না।

বেদান্তবাদীরা সাংখ্যের ‘পুরুষ ও প্রকৃতি’-বিষয়ক মত নাকচ করিয়া দেন। তাঁহাদের মতে এ দুটির মধ্যে যে বিরাট ব্যাবধান রহিয়াছে, সংযোগ-সেতুর সাহায্যে সে ব্যবধান ঘুচাইতে হইবে। একদিকে সাংখ্যমত পৌঁছায় , এবং প্রকৃতিতে পৌঁছিয়াই প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আত্মার কাছে আসিবার জন্য তাহাকে তৎক্ষণাৎ একলাফে অন্য প্রান্তে যাইতে হয়। সাংখ্য মতানুযায়ী এই বিভিন্ন বর্ণগুলি স্বরূপতঃ বর্ণহীন আত্মার উপর ক্রিয়াশীল হইতে সমর্থ হয় কি করিয়া? সেজন্য বেদান্তবাদীরা প্রথম হইতেই নিশ্চয় করিয়া বলেন যে, এই আত্মা ও এই প্রকৃতি এক৬।

এমন কি দ্বৈতবেদান্তবাদীরাও স্বীকার করেন, আত্মা বা ঈশ্বর বিশ্বের শুধু নিমিত্তকারণই নন, তিনি উপাদানকারণও। কিন্তু তাঁহাদের কাছে ইহা কথার কথা মাত্র, প্রাণের কথা নয়; কারণ তাঁহারা নিজ সিদ্ধান্তকে এইভাবেই এড়াইতে চান : তাঁহারা বলেন, বিশ্বে তিনটি সত্তা আছে—ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি। প্রকৃতি ও জীব যেন ঈশ্বরের দেহ; এই অর্থেই বলা চলে যে, ঈশ্বর ও সমগ্র বিশ্ব এক। কিন্তু চিরকাল ধরিয়া প্রকৃতি ও বিভিন্ন জীব পরস্পর স্বতন্ত্রই থাকিয়া যায়। কেবল কল্পারম্ভে তাহারা অভিব্যক্ত হয়, এবং কল্পান্তে সূক্ষ্মাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া বীজাকারে থাকে।